সজল তিলোত্তমা

বর্ষাই দেখেছে তিলোত্তমার ক্রন্দসী নারীরূপ।শ্রাবণের ধারাস্নানে, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে, মিলন-বিরহের জলতরঙ্গে, বাইশে শ্রাবণে– বৃষ্টি নয়, যেন ঝরে চলেছে তিলোত্তমার চোখের জল।সেই জলই আঁজলা ভ’রে তুলে,আমাদের  জীবনের ঘড়াটা ভরে যেতে থাকে।

পাহাড়ের বৃষ্টিতে জমে ওঠে মেঘদূত, রাঙামাটির বৃষ্টি জুড়ে থাকেন রবিঠাকুর আর বর্ষণকালের কলকাতার আনাচে-কানাচে ফাঁকে-ফোকরে উঁকি দিয়ে যান নাগরিক কবিরা –শক্তি-সুনীল-নীরেনরা।তাঁদের কবিতাতেও নীরবিন্দু টুপটাপ ঝরে পড়ে তিলোত্তমার বুকে।শোনা যাক সেই বারিপতনের কথা।

সত্যি তিলোত্তমা, বর্ষা এলে বোঝা যায়, তুমি দিন দিন বড়ো কান্নাবতী হয়ে উঠছ। একটু বৃষ্টিতেই মনে হচ্ছে তোমার ‘চোখের জলে লাগলো জোয়ার’। কে জানে, হয়তো বয়সের ঘড়াটা ভরে যাচ্ছে বলে তা থেকে এত জল উপচে পড়ছে। যে যাই বলুক, জন্মের তিন শতক পরে দিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে তোমার। বুড়ি হয়ে যাচ্ছো নাকি, তিলোত্তমা?অন্তত সেটাই মালুম হচ্ছে তোমার বর্ষা ভেজা শরীরটা দেখলে।বছরভর তুমি যতই সাজগোজ করে থাক না কেন, সব যেন গলে গলে পড়ে বৃষ্টিতে ভিজলে।তখন বোঝা যায় তোমার শরীরজোড়া কত ক্ষত, ত্বকে বলিরেখার আঁচড়।গলিগুঁজির হাঁটুজলে, জলজমা রাস্তার খানাখন্দে তখন স্পষ্ট ধরা পড়ে তোমার অমসৃণ চেহারাটা।দেখে ভারী কষ্ট হয়!

অথচ, একসময় তোমার স্নানভেজা কেশররাশির মতোই রাস্তার গাছগাছালি থেকে চুঁইয়ে পড়তে জল।সে জলে সূর্যের আলো পড়ে কখনও দেখা যেত রামধনু।আর এখন নগরায়ণের নামে তোমার সেই কেশরদাম, পথের ধারের গাছগাছালি নির্বিচারে ছেটে ফেলা হচ্ছে।কৃত্রিমভাবে কিছু ছোটখাটো গাছপালা বসানো হয়েছে অবশ্য, রাস্তার মধ্যিখানে সিমেন্ট বাধানো ডিভাইডারে।কিছু বড় গাছপালা দিয়ে সাজানোও হয়েছে নীল সাদায় রাঙানো ছোট বড় পার্ক।কিন্তু ও যে বড় মেপেঝুপে বিন্যস্ত করে সাজানো।সেখানে তোমার এলোমেলো চুলের মায়া তেমন চোখে পড়ে না, তিলোত্তমা।

আগে তোমার বর্ষাভেজা শরীর থেকে ভেসে আসত কত না ফুলের গন্ধ, সবুজের স্নিগ্ধ সুবাস!আর এখন তোমার অবগাহনের বর্ষাজলে কল-কারখানার রাসায়নিক আবর্জনাময় ঘোলা জলের কটু গন্ধ। কে যে তোমাকে কল্লোলিনী নাম রেখেছিল!এখন তোমার বর্ষারূপ দেখলে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথাগুলো বড্ড মনে পড়ে –‘একটু তেড়ে বৃষ্টি নামলে আর/কথা নেই, আমাদের কলকাতা শহর/অমনি কল্লোলিনী হয়ে ওঠে।/শুধু ঠনঠনিয়া নয়, শুধুই বাজার-বস্তি নয়,…/সর্বত্র তখন শুধু জলের কল্লোল শোনা যায়।’ আর সেই কল্লোলে মিশে থাকে কত না জীবন যন্ত্রণা, নীড় ভেসে যাওয়া করুণ যন্ত্রণা, অনুযোগের হাহুতাশ।ভরা বাদলে মীড়-তান-তেহাইতে গড়া জীবনের সেই আর্ত সুরের মূর্ছনা কি তুমি শুনতে পাও কল্লোলিনি?

কে জানে হয়তো পাও না। বয়সের ভারে শ্রবণশক্তিটা তোমার কমে এসেছে তো।অথচ আগে এমনটা ছিল না। তখন নদী ও নর্দমা বর্ষায় একভাবে বয়ে যেত।বর্ষার পর তোমার অবগাহনের জল নিকাশি হয়ে চলে যেত ম্যানহোলের গহ্বরে, পথের ধারের ড্রেন দিয়ে।বর্ষা জলে নেয়ে তুমি হয়ে উঠতে সাফসুতরো।স্নানের পর বৃক্ষ ছায়ায় আড়াল থেকে সূর্যদেব লুকিয়ে চুরিয়ে দেখে নিতেন তোমার লাবণ্যময় রূপ। আর এখন বিগতযৌবনা নারীর শিথিল শরীরের মতো আকর্ষণহীণ লাগে তোমায়। স্নানভেজা শরীরটার দিকে তাকালে নুয়ে পড়া, ঝুকে যাওয়া রূপটা চোখে পড়ে।

অবশ্য জন্ম থেকেই তুমি নাকি একটু পূব দিকে ঝুঁকেই ছিলে। তারপর যত দিন গড়িয়েছে, শহরের পূর্ব দিকের জমি ভরাট হতে হতে তোমার নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।অনেক পাম্পিং স্টেশন বসিয়ে, খাল সংস্কার করেও খুব একটা কাজ হচ্ছে না।পরিবেশবিদরা বলছেন তোমার ভৌগোলিক চেহারাটা নাকি কড়াই এর মতো। মানে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আরও ন্যুব্জ হয়ে যাচ্ছে তোমার পিঠ।তাই তোমার জলনিকাশির সমস্যা নির্মূল করা কঠিন।এর সঙ্গে শহরবাসীর ব্যবহারের প্লাস্টিক-কাগজে আটকানো হাইড্রেন,জঞ্জালে মজা ড্রেনে এক্কেবারে নোংরা জলে থৈ থৈ তিলোত্তমা। কোথায় সে জমা জলে কচিকাচাদের কাগজের নৌকা ভাসানোর অনাবিল খুশি?সুন্দরীদের পায়ের পাতায় ডুবো জল ছিটিয়ে অন্যকে ভেজানোর খুনসুটি?হাঁটুজল বাঁচিয়ে কারও শক্ত হাত ধরে রাস্তা পার হওয়ার শিরশিরে অনুভূতিটা? হ্যাঁ, এখন আর্মহার্স্ট থানায় উল্টে রাখা লাইভ বোটগুলো বর্ষায় কাজে লাগে ঠিকই। বর্ষায় ঠনঠনিয়া কালী মন্দিরের সামনে মোচার খোলার মত নৌকোও ভাসে। কিন্তু খলখল করে হাসা, কাজলরঙা বস্তির ছেলেগুলোর সেই নৌকো থেকে ঝুপ করে জলে পড়ার দৃশ্য বড়ই দুর্লভ।

এখন রাস্তায় জমা জলে পা ডুবানো মানেই খানাখন্দে পড়ে হাত পা ভাঙার ভয়।অ্যালার্জি কিংবা চর্মরোগের আতঙ্ক। আসলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমারও তো ইমিউনিটি কমে যাচ্ছে তিলোত্তমা। তাই একটু বর্ষা হলেই এখন ডেঙ্গু- মালেরিয়া-ভাইরাল ফিভার-ডায়রিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব।মশক দমন, জলের শোধন এমন অনেক দাওয়াই দিয়েও। সে সব ঠেকানো যাচ্ছে না।

এখনও কিছু মানুষ আছে বর্ষায় যাদের বুকের মধ্যে বৃষ্টি ঝরে। বর্ষায় তারা ঘরের মধ্যেই মেঘদূত জমিয়ে তোলে। তাদের মন মেঘের সঙ্গী হয়ে উড়ে চলে কোন সুদূরে যক্ষপুরীর বন্ধগুহায়। যেখানে বন্দি হয়ে রয়েছে কোনও অতীত, গোপন প্রেমের স্মৃতি অবয়ব।মনের ভিজে ক্যানভাসের পুরনো আবছা মুখগুলো কেমন জলছবি হয়ে ফুটে ওঠে। 

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হজমের জোর কমে আসছে তোমার, তিলোত্তমা।তাই আগের মতো ইলিশ রেঁধে আম-বাঙালির পাতে আর দিতে চাও না তুমি।আগে বাগবাজারে, পোস্তার ঘাটে কত টাটকা গঙ্গার ইলিশ মিলত।এখন আর সেসব কোথায়? গঙ্গার দূষণ, জলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং এমন অনেক কারণে গঙ্গার ইলিশ তেমন ধরা দেয় না জালে। মোহনার মুখে যেটুকুই ধরা পড়ে তাও আবার সাধারন মধ্যবিত্তের ধরাছোঁয়ার বাইরে।ইলিশ মিললেও তার গন্ধটা বর্ষা ভেজা বাতাসে তেমন ছড়ায় না। ফলে এক গৃহস্থের ইলিশ ভোজনের সৌজন্যে তার পড়োশির ‘ঘ্রাণেন অর্ধ ভোজনম’ সারা হয় না। যদিও সীমান্ত-আইনের বেড়াজাল পেরিয়ে পদ্মার ইলিশের কিছু আমদানি হয় বাজারে, কিন্তু তার চার অংকের দাম দেখে রসনা আর বাসনা দুটোকেই দমিয়ে রাখা ছাড়া আর উপায় কি?

শুধু কি মাছ বর্ষায় আকাশছোঁয়া সবজির দাম।বর্ষায় প্রকৃতির তাত কমে বটে, কিন্তু সবজির বাজার থাকে আগুনতাতে। দাম বাড়ার রহস্যভেদ করতে তখন বাজারে বাজারে টাস্ক ফোর্সের টহলদারি। বর্ষায় সুজলাং শহরকে সুফলাং বাজারে পরিণত করার জন্য কত পরিকল্পনা। সব মিলিয়ে বর্ষা পড়লেই তিলোত্তমার শরীর বেহাল, মেজাজ তিরিক্ষে।

বয়স বাড়ছে বলে তিলোত্তমার মনের ফুর্তিতেও ভাটা পড়েছে বোধহয়। তাই বুঝি শহর থেকে হারিয়ে গিয়েছে কোচিং আর টিউটোরিয়ালে পড়ুয়াদের কাগজের নৌকো ভাসিয়ে রেনি ডে উপভোগের মজা।পার্কের কাদা মাখা ফুটবলে পা রেখে বিশ্ব দাপিয়ে বেড়ানোর সেই দামাল কিশোর-তরুণেরা এখন জীবন জীবিকায় ঘাড় গুঁজে রয়েছে। আর হাইরাইজের দাপটে খোলা মাঠও তো হাতে গোণা।এমনকী বৃষ্টির দিনে হাতে টানা রিকশায় বাঁচিয়ে যথাসম্ভব ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে পাশাপাশি বসে সেই একটুকু ছোঁয়া লাগার অনুভূতিটাও আজকের প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে বড্ড বোকা বোকা! নেহাত এখনও কিছু বয়স্ক পেটরোগা বাঙালির পাড়ার মোড়ের তেলেভাজার দোকানগুলোর জন্য টানটা রয়ে গিয়েছে। নাহলে তো ঝরঝর বাদল দিনে সবাই এখন এরককম গৃহবন্দিই।বর্ষার এইসব অনুষঙ্গগুলো এখন লুপ্তপ্রায়।

অবশ্য বর্ষায় যারা ভিড় করে অ্যাকোয়াটিকা, ওয়াটার পার্ক, কিংবা বিভিন্ন ক্লাবের সুইমিংপুলে—কিংবা ওয়াইপার লাগানো গাড়িতে সঙ্গীদের নিয়ে লং ড্রাইভে যায় – তাদের কথাটা অবশ্য আলাদা। আজকের জেনারেশন জেড –এর কাছে বর্ষার রোমান্স মানে খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে  ঢুকতে রাজি আছি’র মতো। কিন্তু সেই খোলামেলায় লুকোছাপার নিষিদ্ধ আনন্দটায় কে যেন জল ঢেলে দিয়েছে।

বর্ষা পড়লেই তুমি কেমন যেন মিইয়ে যাওয়া দেশলাই কাঠির মত হয়ে থাকো, তিলোত্তমা। কিছুতেই যেন তোমাকে জ্বালানো যায় না। অথচ বেশ জানি, ক’দিন পরেই বৃষ্টি ধোওয়া কালো অম্বরখানায় এসে লাগবে সোনালী আলো। তখন তুমি সেই গরদরঙা শাড়ি পড়ে মেতে উঠবে শারদীয়ার উৎসবে। তাই কি বর্ষার উৎসবের প্রতি তোমার এত হেলাফেলা তিলোত্তমা? বর্ষার উৎসব তো এখন সংখ্যায় কত কম! বর্ষার পুরনো কলকাতায় একসময় নাকি জন্মাষ্টমীর দিন মিছিল বের হত।তবে হ্যাঁ বর্ষাতেই গোটা শ্রাবণ মাস জুড়ে তোমার বুকের উপর দিয়ে ফি শনিবার দলে দলে কেটে যায় ‘ভোলে বাবা পার করেগা’র দল। বাবা তারকনাথের মাথায় জল ঢালার পূণ্যির জোরেই যে রাজনৈতিক প্রাপ্তি হয়েছে কারও কারও।কাজেই শ্রাবণের বোম বোম শব্দ তোমার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া ভক্তদের তো আটকানো যাবে না কোনমতেই।

একসময় নাকি খাস কলকাতায় রথের মেলা বসত। সেসব তো কবেই বন্ধ। নেহাত ইসকনের বৈষ্ণবদের দৌলতে রথযাত্রাটায় একটু আমোদ করো তিলোত্তমা। নেতা মন্ত্রী রাজনীতির কেষ্টবিষ্টুরা তখন জড়ো হল রাস্তায়। এরপর থাকে কোনরকমে কয়েকটা লোকদেখানো বৃক্ষরোপন উৎসব। অরণ্য সপ্তাহ –এর প্রথাপালন।আর ইতস্তত কিছু চেনা মঞ্চে বর্ষামঙ্গল। মেঘ আর মিয়ামল্লার –এর আনন্দ-বেদনায় মোড়া মল্লার উতসব আর হয় না বললেও চলে।

তারপর এক বাইশে শ্রাবণে তার চলে যাওয়ার দিনে অঝোরে কেঁদেছিলে তুমি। হয়তো বলেছিলে ‘বন্ধু রহ সাথে/ আজই এ সঘন শ্রাবণপাতে।’ থাকেনি সে। তোমাকেই ছুঁয়ে তার ফুলে ফুলে ঢাকা শরীরটা শেষযাত্রায় গিয়েছিল ‘শ্রাবণঘনগহন মোহে’ গোপন চরণ ফেলে।আজও বর্ষায় ভেসে আসা বাসি বেল ফুলের সুবাসে সেই মৃত্যুগন্ধ বিবশ করে দেয়।

অনেক কালের স্রোত পেরিয়ে এসেছ তুমি তিলোত্তমা।তাই তোমার হৃদপিণ্ডের মতো গঙ্গাবক্ষের স্রোতের গতি শ্লথ হয়ে এসেছে।গঙ্গা এখন তার নাব্যতা হারিয়েছে।ফুলে ফেঁপে ওটা গঙ্গায় মাঝি মাঝি মাল্লাদের সারি গান আর শোনা যায় না। শুধু কি হৃদপিণ্ডের গতি কমেছে? হৃদয়ে প্রেমেও কি ভাটা পড়েনি তোমার? তা না হলে শহরের প্রেমিক-প্রেমিকাদের কথা কেন বোঝনা তুমি?এই বর্ষায় প্রেমিক-প্রেমিকাদের তোমার আঁচলের তলায় আশ্রয় দিতে এত কুন্ঠা কেন তোমার?হাইরাইজ মল, মাল্টিপ্লেক্স এর দাপটে এই শহরে লাভার্স পয়েন্ট -এর সংখ্যা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। বর্ষায় ভগ্নপ্রায় পার্কে, জঞ্জালঢাকা লেকে কাদা প্যাচপেচে করছে রাস্তায় রোমান্সটা কেমন যেন নেতিয়ে পড়ছে। এমনিতেই শহরের পার্কগুলোতে ঢুকতে হলে অনেক হ্যাপা। টিকিটের নজরানা, পাহারাদার নজরদারি। তার উপর বেশিরভাগ স্থানীয় পার্কে কাগজ পেতে বসার মতো বেঞ্চিগুলিও প্রায় উধাও। ভাগ্যিস, সেন্ট্রাল পার্ক, ইকো পার্ক, মিলেনিয়াম পার্ক, ইলিয়ট পার্ক, নলবন, প্রিন্সেপ ঘাট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, রবীন্দ্র সরোবরের মতো জায়গাগুলো রয়েছে। সেখানেই হাত ক’য়েক তফাতে লাল দিন সবুজ ছাতায় মাথা রেখে প্রেমের মেলা বসে। বিকল্পে মাথা ঢাকতে প্লাস্টিকের সামিয়ানার নিচে তনু-মন এক করে বসে তন্ময় প্রেমিক প্রেমিকা।আবার কখনো অঝোর বৃষ্টিতে একই ছাতার নিচে ‘তোমার বৃষ্টিতে আমি আর আমার বৃষ্টিতে তুমি’ ভিজে নেয়ে একেবারে একশা হয়ে যায়। অন্তত এইটুকুর জন্য বছরভর তোমার বৃষ্টি বেলার জন্য সবাই আকুল হয়ে বসে থাকে তিলোত্তমা। নিজেকে শান্ত করতে তখন আওড়াতে হয়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা – ‘বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন পানে একা / দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখা /… কিন্তু তুমি নেই বাহিরে – অন্তরে মেঘ করে / ভারী ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে!’

সত্যি, এখনও কিছু মানুষ আছে বর্ষায় যাদের বুকের মধ্যে বৃষ্টি ঝরে। বর্ষায় তারা ঘরের মধ্যেই মেঘদূত জমিয়ে তোলে। তাদের মন মেঘের সঙ্গী হয়ে উড়ে চলে কোন সুদূরে যক্ষপুরীর বন্ধগুহায়। যেখানে বন্দি হয়ে রয়েছে কোনও অতীত, গোপন প্রেমের স্মৃতি অবয়ব।মনের ভিজে ক্যানভাসের পুরনো আবছা মুখগুলো কেমন জলছবি হয়ে ফুটে ওঠে। ঘরের সামনে চিলতে জমির মাটিতে বর্ষায় ফোটা দীর্ঘকায় গন্ধরাজ আর শ্বেতাঙ্গী কামিনীর আকুল করা গন্ধ উজিয়ে দেয় মিলনের স্মৃতি।পুরনো বাড়ির কার্নিসের ফাঁকে গজিয়ে ওঠা ‘অশ্বথ পল্লবে বৃষ্টি ঝরিয়া মর্মর শব্দে নিশীথের অনিদ্রা দেয় সে ভরিয়া’। ড্রয়িং রুমের ফুলদানিতে রাখা সবুজ পাতা শুদ্ধ ‘বাদল দিনের প্রথম ফুল’ সাদাটে কাটার খোঁচায় মনে করিয়ে দেয় নির্মম সত্য, ‘আজ এনে দিলে হয়তো দিবে না কাল’।নিজেকে সান্ত্বনা দিতে তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার আশ্রয় নিয়ে বলতে হয় – ‘তোমাকে দিয়েছি/ চিরজীবনের বর্ষা ঋতু/এখন আমরা বর্ষাতে আর নেই অধিকার…/তবুও হৃদয় জলদমন্দ্রে কাঁপে যেহেতু/চোখ ঢেকে তাই মনে করি শুধু বিকার।’

বর্ষা এলে আজও হৃদয় জলদমন্দ্রে কাঁপে।বর্ষা এলে আজও মনে হয়, ‘এমন দিনে তারে বলা যায় এমনও ঘনঘন বরিষায়।…এমন দিনে মন খোলা যায়’।আচ্ছা তিলোত্তমা, তোমার কখনও এমন মনে হয়েছে? জীবনে কোনও ভালোবাসার মানুষ ছিল তোমার? কখনও তাকে আপন করে ডেকেছো? বলেছ, ‘মেঘমধুর বরষায় কোথা তুমি?’ সত্যি, তোমার কোন প্রেমিক ছিল?

জীবনের প্রথম লগ্নেই ব্রিটিশরা তোমাকে অনেক সাজিয়েছিল। তাদের নামগুলো এই স্মৃতিভ্রংসের বেলায় তোমার মনে না রাখাই স্বাভাবিক।কত পথভোলা পথিক তোমার কাছে আশ্রয় চেয়েছে কাউকে কি তেমন আপন করে রাখতে চাওনি তুমি তিলোত্তমা? নাকি চেয়েছিলে, বোধহয় একজনকেই। সে তোমারই কোলে জন্ম নেওয়া রবি ঠাকুর। তোমার টানেই শেষ যাত্রার আগে সে ফিরে এসেছিল শান্তিনিকেতন থেকে। মৃত্যুর ডোরে তোমার সঙ্গে সে চিরজীবনের মতো বাঁধা পড়েছে। তারপর এক বাইশে শ্রাবণে তার চলে যাওয়ার দিনে অঝোরে কেঁদেছিলে তুমি। হয়তো বলেছিলে ‘বন্ধু রহ সাথে/ আজই এ সঘন শ্রাবণপাতে।’ থাকেনি সে। তোমাকেই ছুঁয়ে তার ফুলে ফুলে ঢাকা শরীরটা শেষযাত্রায় গিয়েছিল ‘শ্রাবণঘনগহন মোহে’ গোপন চরণ ফেলে।আজও বর্ষায় ভেসে আসা বাসি বেল ফুলের সুবাসে সেই মৃত্যুগন্ধ বিবশ করে দেয়।শহরের ইতিউতি বন্ধ প্রেক্ষাগৃহে রবীন্দ্রপ্রয়াণের অনুষ্ঠানে আজও দর্শকদের চোখে বৃষ্টি নামে ‘শ্রাবণের ধারার মতো’।শ্রাবনে তিলোত্তমার বিরহিনী সাজে জ্বলজ্বল করে ওঠে মৃত্যুর চন্দন টিপ।ছলছল চোখে ধুয়ে যায় মেঘের কাজল। অশ্রুভরা বেদনা দিকে দিকে বাজে।

কার জন্য চোখের জল ফেল তুমি, তিলোত্তমা?বর্ষায় নাজেহাল শহরবাসীর জন্য?ডোবা ফুটপাতে নিরাশ্রয় মানুষের জন্য? অভাবী মেছো বাঙালির জন্য?বৃষ্টিতে নাকাল প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য? নাকি এক বাইশে শ্রাবণে চলে যাওয়া মানুষটির জন্য? কার জন্য তুমি এমন সজল, তিলোত্তমা?জানো বর্ষা হলে সবাই ভাবে, শহরটা ভাসছে। ক’জন বোঝে আসলে তুমিই ভাসছ, তোমার চোখের জলে!

অলঙ্করণ : জয়দীপ গাঙ্গুলী